লিখেছেন স্বপ্নযাত্রার স্বপ্নদ্রষ্টা ও উদ্যোক্তা জনাব আরিফ সিকদার
“স্বপ্নযাত্রা” – স্বপ্ন পূরণের গল্প
২০১৫ সাল। উন্নয়নকর্মী মহুয়া আপা একদিন ফোন করে বললেন, একটা ছেলে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে; কিন্তু টাকার অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারছেনা। আপনার পক্ষে কি সম্ভব হবে ছেলেটিকে সহায়তা করা? আমি কোনকিছু না ভেবেই আমার সাথে দেখা করতে বলে দিলাম; বললাম, যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
কয়েকদিন পর এক ভদ্রলোক একটি ছেলেকে নিয়ে আসলেন। ভদ্রলোক পেশায় গাড়ীচালক। আলোচনার এক পর্যায়ে জানলাম ছেলেটির বাড়ী আমার গ্রামের পাশের গ্রামে। নাম রিপন। সব শুনে আমি তাকে আশ্বস্থ্য করলাম এবং প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে সহায়তা করা শুরু করলাম। ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কিন্তু আমার ভিতরে এক ধরণের ব্যথা অনুভব করলাম। পিছনের কিছু স্মৃতি আমাকে কয়েক মূহুর্তের জন্য আচ্ছন্ন করল। সিদ্ধান্ত নিলাম; ওকে এককালীন কোন সহায়তা না করে মাষ্টার্স পর্যন্ত সাধ্যমতো সহায়তা করে যাবো।
২০১৮ সাল। আমার একমাত্র ছেলে সিকদার আসিফ রুমি। বয়স ১০। ওকে আমরা রুমি নামেই ডাকি। একটি জরুরী কাজে থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম; সাথে আমার ছেলেটিও। একদিন সামান্য কিছু শপিং করে হোটেলে ফিরছিলাম, হেঁটে। দু’হাতে ব্যাগ। তাই ওকে ধরে হাটতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেখি পাশে ছেলেটি নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি; না, নজরে পড়ছেনা। অস্থির হয়ে গেলাম। একটু পিছনে গিয়ে দেখি রুমি পকেট থেকে কয়েন বের করছে। সবগুলো কয়েন রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা এক গরীব লোককে দিয়ে দিলো। লোকটির সাথে একটি ছোট ছেলেও ছিল। কি হোলো বাবা? জিজ্ঞেস করলাম। বললো, ‘বাবা লোকটি তো অনেক গরীব তাই দিয়ে দিলাম। ছেলেটিও চাচ্ছিল। ওদেরতো খেতে হবে, ছেলেটি পড়াশোনা করবে।’
গত কয়েক দিনে অনেক কয়েন জমিয়েছে। কয়েন ওর অনেক প্রিয়। আমাকে বলতো ‘বাবা সবগুলো কয়েন আমি জমিয়ে রাখবো। এটা আমার সখ।’ অনেকবার খরচ করতে চেয়েছি; ও মোটেও রাজি হয়নি। কিন্তু এখন ওর সখের জমানো প্রিয় কয়েনগুলো এদের দিয়ে দিল? আমি অবাক হলাম, আমার দশ বছরের ছেলেটির কথায়। সেই সাথে লজ্জাও পেলাম। সেদিনের সেই ঘটনাটি ছিল আমার জীবনে অন্যরকম; যা আমাকে আজকের এ উদ্যোগটি গ্রহণে সহায়তা করেছে।
এবার একটু পিছনে যাই, আমার ছোট বেলা। বয়স মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে; তেমন কিছু বুঝিনা। আমার বাবা তখনো গ্রামে থাকে। বলা যায় বেকার। দাদার সম্পদের উপর ভর করেই সংসার চলতো। আমরা ছয় ভাই-বোন। লেখাপড়ার খরচ চলতো কোনভাবে। আমাদের ছোটখাটো অনেক আবদারই পূরণ হতোনা। এরই মাঝে আমার সহজ-সরল বাবা অনেক এতিম ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমার এখনো মনে পড়ে, কোন এক বর্ষায় বাবা নিজেই নৌকা বেয়ে অন্য একটি গ্রামের এতিম ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। আমিও ছিলাম বাবার সাথে, বৈঠা মেরে নৌকা চালাতে সাহায্য করছিলাম। বাবা অনেক ছেলেমেয়েকে সরকারি এতিমখানায় ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বাবা তাঁর নিজ সন্তানদের প্রতি যথাযথ খোঁজ না নিলেও গরীব কিংবা এতিম ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা ঠিকই করতেন। তাই বলা যায়, আজকের এ উদ্যোগের সাথে আমার পরিবারের ঐতিহ্যের একটা যোগসূত্র রয়েছে; যা জিনগত।
২০১৯ সাল। মূলতঃ ব্যাক্তিগত ভাবে আমি একজন উন্নয়ন কর্মী। সামাজিক কাজ নিয়েই আমার জীবন। দেশের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের দুঃখ-বেদনা আমাকে ভাবায়। সুবিধা বঞ্চিত দরিদ্র পরিবারের কষ্ট আসলেই বেদনাদায়ক। আর্থিক কারণে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হয় এবং এই পরিবারগুলো বংশানুক্রমে দরিদ্রই থেকে যায়। আমার কাছে মনে হয়, একটি পরিবারে যদি একজনকে শিক্ষিত করা যায়; তাহলে পুরো পরিবারের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। ভবিষ্যত প্রজন্ম শিক্ষিত হয়। একজন শিক্ষিত মানুষই পারে শিক্ষিত পরিবার উপহার দিতে; সুশিক্ষিত এবং স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে। এসব ভাবনা থেকেই মনে হয়েছে আমার এ ছোট উদ্যোগটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া দরকার, আরও অনেককে এ উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। সেই লক্ষেই উদ্যোগটির নাম দিলাম “স্বপ্নযাত্রা”। একটি স্বপ্নের শুরু।
Related Posts
আইনজীবী হওয়াই ‘প্রণয়ের’ অভিপ্রায়
ক্লান্ত বিকেল, সময় ঠিক পাঁচটা। আমার অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। ভাবছেন কিসের অপেক্ষা?Read More
পিতার ভবিষ্যৎ ভরসাস্থল, শিক্ষকের আদর্শ ছাত্রের অনন্য দৃষ্টান্ত রিপন হোসাইন
রিপন হোসাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। সে গজারিয়া উপজেলার উত্তরশাহাপুর গ্রামে বাস করে।Read More